বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত আদানিরা যেহেতু মায়ানমারের সামরিক শাসকদের কাছ থেকে বন্দর লিজ নিতে চায়, সেই কারণেই কি নয়াদিল্লি মায়ানমারের সামরিক শাসকদের অত্যাচার এবং নির্বিচার দমন পীড়নকে পরোক্ষে সমর্থন করছে?
মায়ানমারের সামরিক শাসকদের লাগাতার গুলি চালানো এবং দমন পীড়ন নিয়ে যখন গোটা বিশ্ব সোচ্চার, আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলি একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করছে, তখন ভারতের নিশ্চুপ অবস্থান ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। ঠিক সেই সময় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একাধিক সংবাদ সংস্থা ছবি এবং ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করেছে, ভারতের আদানি শিল্প গোষ্ঠী মায়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে চুক্তি চূড়ান্ত করার পথে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ওই সংবাদ সংস্থাগুলি দাবি করেছে, আদানিরা যদি মায়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে চুক্তি করে ফেলে, তাহলে বিদেশি ‘ফান্ড’ পাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে। বিশেষ করে অষ্ট্রেলিয়ায় সেখানকার কয়লা খনি নেওয়ার বিষয়ে আদানি শিল্পগোষ্ঠী যতটা এগিয়ে গিয়েছিল, সেক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ আরোপ করার দাবি তোলা হয়েছে।
এই করোনা কালে অ্যামাজন কর্তা জেফ বেজোস বা টেসলা প্রধান ইলন মাস্ক-এর চাইতেও যাঁর সম্পদ বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে সেই গৌতম আদানি শেষ পর্যন্ত কি করেন, সেদিকে গোটা বিশ্বের চোখ রয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই প্রতাপ ভানু মেহেতার মতো বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক এবং তাত্ত্বিকরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন মায়ানমারের ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি ঠিক কোন অবস্থান নিয়ে চলতে চায়? কারণ এতদিন ধরে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারত নিজেকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, এবং অন্য সব দেশে গণতন্ত্রের পাশেই দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়েছে। তাহলে মায়ানমারের সামরিক শাসকদের নিষ্ঠুর দমন পীড়নের বিরুদ্ধে নয়াদিল্লি মুখ খুলছে না কেন?
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বা গোটা এশিয়াতেই ভারত নিজেদের একটি নির্বাচিত গণতন্ত্র হিসাবে ভাবমূর্তি ধরে রাখতে সদা তৎপর এবং এটাই নয়াদিল্লি ও বেইজিং-এর নিজস্ব নিজস্ব ঘোষিত রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রগত অবস্থানের তফাৎ। চিনে যেখানে এক দলীয় শাসন চলে, গণতন্ত্র শব্দটারই কোনও অস্তিত্ব নেই, সোশ্যাল মিডিয়ার উপরও প্রচুর বিধিনিষেধ, সেখানে ভারত ক্রমাগত নিজেকে একটি ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ হিসাবে প্রকাশ করতে চেয়েছে। আমেরিকার বিভিন্ন থিঙ্কট্যাঙ্ক নরেন্দ্র মোদীর সরকারের আমলে গণতন্ত্রের অবনতি হয়েছে বলে যতই নিশানা করুক, ভারতীয় বিদেশমন্ত্রক তাকে উড়িয়ে দিয়েছে। কারণ, নয়াদিল্লি ভালই জানে এটাই গোটা বিশ্বের কাছে চিনের সঙ্গে তাদের তফাৎ গড়ে তোলে। আর এই তফাৎ এর উপর ভিত্তি করে ভারত তার পররাষ্ট্রনীতি সাজায়, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে, এশিয়া বা আফ্রিকাতে ‘আধুনিক’ দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার চেষ্টা করে।
তাহলে মায়ানমারের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে কেন? ভারতের বিভিন্ন সরকারী সংস্থার তরফে প্রায়শই পরোক্ষভাবে বলা হয় যে মায়ানমারের রাজনীতিতে গত চল্লিশ বছর ধরেই সেনাবাহিনী এতটা প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে যে তাদের সঙ্গে না নিয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। এবং মায়ানমারের সঙ্গে ভারতবর্ষের যেহেতু প্রায় ১৬শো কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে, তাই সেদেশের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সবসময় আমাদের সুসম্পর্ক রেখে চলতে হয়। এই সবকিছুকে মেনে নিলেও প্রশ্ন ওঠে তাহলে মায়ানমারের গণতন্ত্র বা সেদেশের রাজনীতি নিয়ে নয়াদিল্লি কি ভাবছে? আমাদের মনে রাখতে হবে ভারতবর্ষের সঙ্গে আজকের মায়ানমার বা অতীতের বার্মার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে বার্মার গণতন্ত্রকামী ছাত্রদের জেল থেকে মুক্তি চেয়ে যে চিঠি প্রবাদপ্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী লক্ষ্মী সাহগল লিখেছিলেন, সেটাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন। আজাদ হিন্দ ফৌজের অন্যতম সেনানী লক্ষ্মী সাহগলের বক্তব্য ছিল, সুভাষ চন্দ্র বসু যখন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ডাক দিয়ে সেনাবাহিনী তৈরি করে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া দিয়ে ভারতের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন বার্মার মানুষ সর্বোতভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। ভারতবর্ষের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষদের সেকথা কোনোদিন ভুলে গেলে চলবে না।
সমস্যা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র মোদী মহাত্মা গান্ধীকে স্মরণ করলেও বা তাঁর ডান্ডি মার্চ-এর স্মৃতিতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলেও দল হিসাবে বিজেপি ভারতবর্ষের এই ঐতিহ্য বা ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’র গুরুত্বকে ভালো বোঝে না। ভারত নিজে যদি গণতন্ত্রের রোল মডেল না থাকে এবং অন্য দেশে গণতন্ত্রকে সমর্থন না করে, তাহলে কি বিপদ, সেটা গেরুয়া শিবিরের পক্ষে আন্দাজ করা কঠিন। তার উপরে রয়েছে নিজেদের ঘনিষ্ঠ শিল্পপতিদের বিভিন্ন ধরনের চাপ। এর আগে শ্রীলঙ্কাতেও আদানি গোষ্ঠীর বন্দর পাওয়া নিয়ে গোলমাল হয়েছিল এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির বিক্ষোভের জেরে কলম্বোর রাজাপক্ষ সরকারকে পিছু হঠতে হয়েছিল। কিন্তু মায়ানমারের বিষয়টি আরও জটিল, কারণ এখানে সামরিক প্রশাসকদের সঙ্গে সমযোতার অভিযোগ উঠেছে সেই গৌতম আদানির শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
স্বভাবতই ভারতবর্ষের সমাজকর্মীরা, মানবাধিকার আন্দোলনের নেতারা প্রশ্ন তুলছেন, নয়াদিল্লির কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? কোনও শিল্পগোষ্ঠীর বানিজ্যিক স্বার্থ না নিজেদের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি?